হার্ট এ্যাটাক, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং স্ট্রোক।


আমরা প্রায়-ই এগুলো শুনে থাকি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এইগুলি কি বা এদের মধ্যে পার্থক্য কি? অনেকেই মনে করি এগুলো একই সমস্যা। তাই আপনাদের জন্য কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

প্রথমেই আমাদের জানা দরকার হৃদপিন্ডের কাজ কি?

হৃদপিন্ড একটা পাম্প যা সমস্ত শরীরে রক্ত সরবরাহ করে। এই রক্ত প্রধানতঃ অক্সিজেন যুক্ত রক্ত। সমস্ত শরীরে ব্যবহারের পর অক্সিজেন বা বাতাস যখন নিঃশেষ হয়ে যায় তখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড যুক্ত রক্ত পুনরায় হৃদপিন্ডে প্রবেশ করে।


● হার্ট এ্যাটাকঃ

প্রকৃত পক্ষে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় হার্ট এ্যাটাক বলে কিছু নেই। সাধারণ মানুষের কাছে যা হার্ট এ্যাটাক বলে পরিচিত তা আসলে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (Myocardial Infarction) বা সংক্ষেপে এম.আই.। হার্ট যদিও সারাদেহে রক্ত সরবরাহ করার পাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে এই কাজের জন্য তার নিজের মাংসপেশীতেও খানিকটা রক্তের প্রয়োজন পড়ে। এই রক্ত সরবরাহ করার জন্য যে রক্তনালীগুলো থাকে এই গুলো যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন হার্টের খাকিটা অংশ মরে যায়। এটাকেই এম.আই বা সাধারণ ভাষায় হার্ট এ্যাটাক বলে।

লক্ষণসমূহঃ

১। বুকের মাঝখানে শুরু হয়ে বাম কাধ, চোয়াল এবং বাম হাতের আঙ্গুলের মাথা পর্যন্ত তীব্র/সুঁচ ফোটানোর মত ব্যথা অথবা চাপ। ক্ষেত্র বিশেষে ডান দিকে এমনকি শরীরের অন্যত্রও এই ব্যথা অনুভূত হবে পারে।
২। অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
৩। বমি হওয়া।
৪। বুকে ওজন অনুভূত হওয়া
৫। পায়ে পানি আসা বা পা ফোলা (এটা দেরিতে হতে পারে)

করণীয়ঃ

১। আক্রান্ত ব্যক্তির হৃদপিন্ডের কাজ যত কম করা যায় তার ব্যবস্থা করে তাকে চিকিৎসার জন্য জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
২। আক্রান্ত ব্যক্তির জ্ঞান থাকলে, তাকে হাঁটু ভাঁজ করে হেলান দিয়ে বসার জন্য সাহায্য করতে হবে।
৩। আক্রান্ত ব্যক্তির গলা, বুক এবং কোমড়ের কাপড় ঢিলা করে দিতে হবে।
৪। প্রতি দশ মিনিট পর পর আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস ও নাড়ীর গতি, পরীক্ষা করতে হবে।
৫। আক্রান্ত ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তার শ্বাসনালী খোলা রেখে শ্বাস পরীক্ষা করতে হবে।
৬। অসুস্থ ব্যক্তিকে জরুরী ভিত্তিতে স্ট্রেচারে করে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হার্ট এ্যাটাক হওয়ার ৬ ঘন্টার মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নেয়া অত্যন্ত জরুরী।

কি করা যাবে নাঃ

১। আক্রান্ত ব্যক্তিকে অযথা চলাফেরা করতে দেয়া যাবে না। কারণ, এতে করে তার হৃদপিন্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়বে এবং তার ক্ষতি হবে।


● কার্ডিয়াক অ্যারেস্টঃ

যখন হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বা স্পন্দন হঠাৎ করে বন্ধ হয়য়ে যায় অর্থাৎ হৃদপিন্ড রক্ত শরীরের অন্যান্য স্থানে পাম্প করা বন্ধ করে দেয়, তখন তাকে বলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া।

লক্ষণসমূহঃ

১। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়য়ে আশা।
২। পালস (Pulse) না পাওয়া যাওয়া।
৩। আক্রান্ত ব্যাক্তিকে নাম ধরে বা কাঁধ ধরে ঝাকালেও কোন উত্তর না দেওয়া বা বুঝতে না পারা।
৪। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
৫। বুকে ব্যাথা হওয়া।

করণীয়ঃ

১। এক্ষেত্রে সময় খুব কম এবং আক্রান্ত ব্যাক্তিকে যতদ্রুত সম্ভব নিকটস্ত হাসপাতালে নিতে হবে।
২। এক্ষেত্রে কিছুটা অভিজ্ঞ বা কোণ ডাক্তার থাকলে তাকে CPR (Cardiopulmonary Resuscitation) দিতে হবে। CPR এর মধ্যে রয়েছে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে বাতাস দেওয়া, বাইরে থেকে হৃদপিন্ডের উপর চাপ দিয়ে রক্তসঞ্চালন যতটা সম্ভব চালু রাখার চেষ্টা করা ইত্যাদি।

● স্ট্রোকঃ

স্ট্রোক (Stroke) রোগটির নাম শুনলে যদিও হার্ট এটাক এর কথা মনে আসে, স্ট্রোক আসলে মস্তিস্কের রোগ। মস্তিস্কের কোনো স্থানের রক্ত নালী বন্ধ হয়ে গেলে বা ব্লক হলে ঐ স্থানের রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মস্তিস্কের ঐ বিশেষ এলাকা কাজ করতে পারেনা। এটিই স্ট্রোক রোগ।

মস্তিস্কের ঐ বিশেষ এলাকাটি শরীরের যে যে অংশকে নিয়ন্ত্রন করতো স্ট্রোক হলে সে সকল অংশের বিভিন্ন অংগ বিকল হয়ে পরে। মস্তিস্কের এক দিক নস্ট হলে শরীরের উল্টো দিক বিকল হয়ে পরে। অর্থাৎ মস্তিস্কের বাম দিকে ক্ষতি হলে শরীরের ডান দিক অচল/অবশ হয়ে যায়।

মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্ত সরবরাহে ব্যঘাত ঘটার ফলে যে অব্যবস্থা দ্রুত জন্ম নেয় তাকে বলা হয় স্ট্রোক (Stroke)। দেহের রক্তের মাত্র ২% মস্তিষ্ক ব্যাবহার করে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্ক কোষসমূহ অত্যন্ত সংবেদনশীল---অক্সিজেন বা শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলে দ্রুত এই কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ওই কোষগুলো শরীরের যেই অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ওই অংশ গুলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।

লক্ষণসমূহঃ

১। হাঁটতে বা চলাফেরা করতে এবং ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হয় এবং মাথা ঝিমঝিম করে।
২। কথা জড়িয়ে যায় এবং অস্পষ্ট শোনায়।
৩। শরীরের একপাশ দূর্বল, অসাড় ও প্যারালাইজড হয়ে যায়।
৪। চোখে কোন কিছু অস্পষ্ট, অন্ধকার ও দুইটি দেখা যায়।
৫। অস্বাভাবিক মাথা ব্যথার সাথে ঘাড় ব্যথা, মুখ ব্যথা, দুই চোখের মধ্যখানে ব্যথা, বমি হয়।(স্ট্রোক সনাক্তকরণের সহজ তিনটি ধাপ আছে। স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ সনাক্তকরণ নিয়ে ইতোপূর্বে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। এখান থেকে সেটি দেখে নিতে পারেনঃ https://www.drfaisal.com.bd/2023/01/stroke-s-t-r.html)

করণীয়ঃ

১। এক্ষেত্রে আপানার উচিৎ হবে সময় নষ্ট না করে যতদ্রুত সম্ভব আক্রান্ত ব্যাক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। মনে রাখবেন যতদ্রুত হাসপাতালে নিতে পারবেন, সেই রোগীর সুস্থ হবার সম্ভবনা তত বেশি থাকে।
২। রোগীকে নড়াচড়া বা কোন কাজ থেকে বিরত রাখুন।

Comments