হিট স্ট্রোক: হতে পারে মৃত্যুও!


প্রচণ্ড গরমে এখন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দেশবাসী। তার উপরে আবার চলছে রমজান মাসে। এই গরমে দীর্ঘক্ষণ পানি পান না করে থাকার কারণে ও তীব্র তাপদাহে যখন তখন যে কারও হতে পারে হিট স্ট্রোক।

দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৪২ ডিগ্রিতেও। এই প্রচণ্ড গরম কারও কারও জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এই তাপমাত্রায় দিনের পর দিন বাইরে থাকলে বা কাজ করলে ‘হিট এক্সশ্চন’ বা ‘হিট স্ট্রোক’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি!


হিট স্ট্রোক কী?

গরমের সময়ের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিট স্ট্রোক। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী, প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে তাকে হিট স্ট্রোক বলে।

স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। প্রয়োজনে ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক হয়।



হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয়?


  • শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, যা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক।
  • শরীরে পানিস্বল্পতা হলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
  • কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্নতার ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।


হিট স্ট্রোকের লক্ষণসমূহঃ


১। শরীরের তাপমাত্রাঃ শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে যায়।

২। তীব্র মাথাব্যথাঃ প্রচণ্ড গরমে মাথাব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া গরমে মানুষের মাইগ্রেন ট্রিগার করতে পারে। এটি হিট স্ট্রোকের একটি লক্ষণ হতে পারে।

৩। প্রচণ্ড তৃষ্ণা, পানিশূন্যতা, ঘামঃ হিট স্ট্রোকের আগে ব্যক্তি চরম তৃষ্ণা অনুভব করতে পারে, সেইসঙ্গে ডিহাইড্রেটেড এবং আড়ষ্টতা অনুভব করতে পারে। শরীর নিজেকে ঠান্ডা করার জন্য অতিরিক্ত ঘাম তৈরি করতে পারে।

৪। দ্রুত হৃদস্পন্দনঃ হিট স্ট্রোকের আগে হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হতে পারে।

৫। হাইপারভেন্টিলেশনঃ শ্বাসকষ্ট এবং দ্রুত ও ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসও হিটস্ট্রোকের লক্ষণ।

৬। বমি বমি ভাবঃ মাথাব্যথা, দ্রুত হৃদস্পন্দন ও হাইপারভেন্টিলেশন থেকে অক্সিজেনের অভাব ইত্যাদির কারণে হিট স্ট্রোকের আগে বমি বমি ভাব হতে পারে।

৭। বিরক্তি, বিভ্রান্তি বা প্রলাপ বকাঃ অতিরিক্ত তাপের কারণে হিটস্ট্রোকের আগে মানুষ বিরক্ত বোধ করতে পারে, রাগান্বিত হতে পারে, অযৌক্তিক কথা বলতে পারে এবং এমনকি প্রলাপ বকতে করতে পারে।

৮। কথা জড়িয়ে যাওয়াঃ হিট স্ট্রোকের আরেকটি লক্ষণ কথা জড়িয়ে যাওয়া। ব্যক্তি অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করতে পারে।

৯। পেশিতে ব্যথাঃ হিট স্ট্রোকের আগে যেসব লক্ষণ দেখা যায়, তারমধ্যে একটি হলো পেশি ব্যথা। যদিও সাধারণ ব্যথা ভেবে মানুষ এটা গুরুত্ব দেয় না।

১০। দুর্বলতা ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়াঃ অতিরিক্ত উত্তাপের শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাজ করে। শরীরে আরও ক্লান্তি ও দুর্বলতা তৈরি হয়। ব্যক্তি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। এগুলো হিট স্ট্রোকের লক্ষণ।

১১। ঘাম না হওয়াঃ হিট স্ট্রোকের একটি লক্ষণ হল প্রচণ্ড গরমেও ঘাম না হওয়া। সাধারণত এর মানে হচ্ছে, শরীরে ঘাম হওয়ার মতো পানি আর নেই বা শরীরের প্রাকৃতিক শীতল প্রক্রিয়াটি কাজ করছে না।



হিট স্ট্রোকে প্রাথমিক করণীয়ঃ



প্রথম কাজ- ছায়ায় নিয়ে আসুন রোগীকে। ‘রিহাইড্রেশন’ বা পানি পানের ব্যবস্থা করুন! ওর-স্যালাইন সবচেয়ে ভালো! শুধু ঠাণ্ডা পানি হলেও চলবে প্রথমে।

আশপাশে পুকুর থাকলে গলা পর্যন্ত পুকুরের পানিতে নামিয়ে দিন। পুকুর না থাকলে বাথটাবে শুইয়ে দিন এবং পানির মধ্যে কিছু বরফ ঢেলে দিন। তাও না থাকলে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করিয়ে দিন। তারপর টেবিল ফ্যান দিয়ে শরীর শুকিয়ে দিন।

টেম্পারেচার বা তাপমাত্রা না নামলে আবার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে দিন। সম্পূর্ণ গতিতে টেবিল ফ্যান চালিয়ে দিয়ে শরীর শুকিয়ে দিন।

মনে রাখতে হবে ঠাণ্ডা পানির ‘রিহাইড্রেশন’ খুব জরুরি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে শুধু পানি অতিরিক্ত খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। সে জন্য ওর-স্যালাইন উপকারী।

এরপর দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।



হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীঃ

১.বাইরে বেরনোর সময়ে টুপি, ছাতা সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। অর্থাৎ যা আপনার শরীরের বেশিরভাগটাই ঢেকে রাখবে, তেমন জিনিস অবশ্যই সঙ্গে রাখুন।

২.শরীরে পানির অংশের পরিমাণ সঠিক রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি খান।

৩.বাইরে বের হলে সঙ্গে সবসময় পানির বোতল রাখুন। হালকা রঙের হালকা জামাকাপড় পড়ুন।

৪.বেশি শারীরিক কসরত করবেন না।

৫.ক্যাফেইন, অ্যালকোহল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।

৬.স্বাস্থ্যকর খাবার খান। তেলে ভাজা খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।


হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে যা খেতে পারেনঃ

  • আম পান্নাঃ কাঁচা আম সেদ্ধ করে জুসটা বের করে নিন। এবার ওই কাথ ছেঁকে নিয়ে ওর সঙ্গে জিরে গুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়ো, সামান্য নুন আর চিনি মিশিয়ে তৈরি করুন আমের পান্না। ওপর থেকে পুদিনা পাতা দিয়ে দিন।

  • পেঁয়াজঃ গরমকালে প্রতিদিন কাঁচা পেঁয়াজ খান। হতে পারে তা ভাতের সঙ্গে। কিংবা রুটি, মুড়ির সঙ্গেও খেতে পারেন। আর পেঁয়াজের জুসও বানিয়ে নিতে পারেন। জুস বানিয়ে ওর সঙ্গে খানিকটা মধু মিশিয়ে নিন। এতেও শরীরের তাপমাত্রা থাকবে নিয়ন্ত্রণে।
  • বাটার মিল্ক খানঃ বাটার মিল্ক শরীরের জন্য খুব ভালো। শরীরকে ঠান্ডা রাখে বাটার মিল্ক। কারণ এর মধ্যে থাকেন প্রোটিন, প্রোবায়োটিক, ভিটামিন। সেই সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রাও থাকে নিয়ন্ত্রণে। যদি খুব বেশি গরম হয়ে যায় শরীর তাহলে খুব সহজেই ঠান্ডা করে দেয় বাটার মিল্ক।

শিশু ও বয়স্কদের জন্য টিপসঃ

সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোক এক রকম হলেও, বয়স্ক ও শিশুদের প্রতি আলাদা নজর রাখা জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে যেন তাদের শরীরে কোনভাবেই পানিশূন্যতা দেখা না দেয়। যেহেতু ১-২ বছর বয়সী শিশুরা নিজেদের শারীরিক অসুবিধাগুলোর কথা বলতে পারে না। তাই গরমের দিনে তাদের বার বার পানি বা শরবত দিতে হবে। শরীরের তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়তে দেয়া যাবে না। তাদের খোলামেলা জায়গায় বা প্রচুর বাতাস আছে এরকম জায়গায় রাখতে হবে।

শিশুদের মতো বয়স্কদের জন্যও খোলামেলা স্থান বাছাই করা উচিত। যাদের ডায়াবেটিস (diabetes)– এর সমস্যা রয়েছে তাদের শরবত বা মিষ্টি জুস না দিয়ে পানি, ডাবের পানি এগুলো দিতে হবে।

এই গরমে আমি বা আপনি যেকোনো সময়ে হিট স্ট্রোক-এ আক্রান্ত হতে পারি। তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধের বা মোকাবেলার উপায়গুলো জানা থাকলে আমরা খুব সহজেই এই পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। সবাই সুস্থ থাকুন, এই কামনা রইলো।



Comments